Sunday, September 10, 2023

স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি



"...রাষ্ট্রীয় জাতি হিসেবে আমরা নতুন। মাত্র বাইশ বছর আগে আমাদের জন্ম। আমাদের চিন্তার অস্বচ্ছতা ও অপরিচ্ছন্নতার শুরু এখানেই। ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা' ওয়ালারাই এ জন্য দায়ী। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। হঠাৎ কোন ভুঁইফোঁড় চরাঞ্চল নয়। নিদেন পক্ষে দু' হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস আমাদের উজ্জ্বল অতীত। এর মধ্যে সাতশ' বছরেরই ইতিহাস উজ্জ্বলতম। এ সময়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা এদেশ ও এর আশপাশের বিরাট ভূখণ্ড সাফল্যের সঙ্গে শাসন করেছে। বিদেশীর মত উচ্চাসনে বসে নয়। এদেশকে মাতৃভূমি হিসেবে গ্রহণ করে শেষে এদেশের মাটিতেই বিলীন হয়েছিলেন আমাদের পিতৃপুরুষরা।

আর্যরা কোনোদিনই এদেশ জয় করতে পারেনি। অনেক যুগ ধরেই দ্রাবিড়দের দখলে ছিল। এরা আর্য ধর্মের চেয়ে বর্ণ বিরোধী বৌদ্ধ দর্শনের সাম্যবাদের দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়। বাংলার পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন। পাল রাজারা আর্যকৃষ্টি ও সংস্কৃতের আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করেন। এরপর সেন রাজারা আবার বাংলার নিজস্ব ভাষা-কৃষ্টিতে আর্য কৃষ্টি ও সংস্কৃত চাপাবার প্রচেষ্টা চালায়। ইতিহাসের এমনি ক্রান্তিলগ্নে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত। এরপর একটানা সাড়ে সাতশ' বছর চলে নতুন কৃষ্টি-সাহিত্যের নির্মাণ কাজ। ইংরাজ শাসনে তাদের কূটনৈতিক প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সূত্রপাত ঘটায়।

পুরো একুশ' বছরের অবিরাম চেষ্টায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে এ প্রচেষ্টা সফল হবার লক্ষণাদি স্পষ্ট হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্বাভাবিক ও সংখ্যাগুরু ব্যবহৃত আরবী-ফার্সী শব্দগুলো বিসর্জিত হতে থাকে, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে শুরু হয়েছিল যার দিক-নির্দেশনা। ক্রমেই মেজরিটি মুসলিম কৃষ্টির সঙ্গে মাইনরিটি হিন্দু কৃষ্টির সংঘাত দেখা দেয়। প্রচলিত বাংলা শব্দের সাথে নব্য আমদানিকৃত সংস্কৃত শব্দের বিরোধ দেখা দেয়। বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্কিম বিদ্যাসাগরী নেতৃত্বে এ সময়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে শুধুমাত্র হিন্দু প্রাধান্যে সম্প্রসারিত হয়। এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ এ সময়েই রোপিত হয় যা কালে ফলে-ফুলে বিকশিত হয়। পাকিস্তান দাবির পিছনে মুসলিম বাংলার বিপুল সমর্থনেরও পরোক্ষ কারণ ওটাই। মুসলিম পণ্ডিতগণ অভিমান বশে অসম ও নিরর্থক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে সরে দাঁড়িয়ে হয় পুঁথি সাহিত্যে নয় ধর্মীয় সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রকারান্তরে হয়ে দাঁড়ায় মাইনরিটির ভাষা সাহিত্য। মেজরিটি হয় নির্বাসিত।

এ পটভূমিকায় সমগ্র ভারতে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি উঠলে বাংলার মুসলমান আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। এ কারণেই পাকিস্তান দাবির পিছনে সর্বাপেক্ষা বেশি সমর্থন দেয় অর্ধশিক্ষিত, বঞ্চিত, বিভ্রান্ত, আধপেট খাওয়া বাংলার মুসলিম সমাজ। ইতিমধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও লাখেরাজ আইনে ভূস্বামীত্ব থেকে বিতাড়িতের ভাগ্য মেনে নিয়েও এরা নিজেদের জাতিসত্তাকে বিসর্জন দেয়নি। দুইশ' বছরের বৃটিশ শাসনামলে বাংলাদেশের দু'টি স্রোতমান ধারার একটি উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করে অপরটি অবনতির শেষ ধাপে নেমে যায়। মুসলমানদের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র হোমল্যাণ্ডের দাবির মধ্যে এ কারণেই খুঁজে পায় এর প্রতিকার। বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে যারা জাতীয়তাবাদের সমর্থক যেমন সৈয়দ নওসের আলী, অধ্যাপক হুমায়ন কবির প্রমুখ সম্প্রদায় ভিত্তিক বিভাগের বিরোধী ছিলেন আগাগোড়া। কিন্তু এরা স্বসমাজে ছিলেন ধিকৃত কেননা হিন্দু সমাজের অন্যায়-অবিচারের কোন প্রতিকারের পথ এরা নিজেরাও জানতেন না অতএব বলতেও পারতেন না।
রবীন্দ্রনাথের মত বিশাল প্রতিভার জন্ম দেয় এদের একটি সমাজ। এ প্রতিভা বিশ্বকবির মর্যাদা লাভ করলেও বাঙ্গালী সংখ্যাগুরুর প্রতি উপেক্ষা করায় বাংলাদেশের জাতীয় কবি হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। তার সমগ্র রচনায় আনন্দময়ী আগমনের ডঙ্কা বারবার বেজে উঠলেও বিশাল মুসলিম বাংলার আকাশে একবার ঈদ বা মহররমের চাঁদ উঠতে দেখা যায়নি। এটা রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থতা কোনো অযৌক্তিক কটূক্তি নয়। তাঁর প্রতিভার বিশালত্ব অস্বীকার করার উপায় নাই এবং সে চেষ্টা করিনি করবওনা কিন্তু একটি সংখ্যাগুরু জাতিসত্ত্বাকে উপেক্ষা করে তিনি কখনও আমাদের জাতীয় কবি হবার দাবিদার হতে পারেন না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্র হয়ে রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরৎচন্দ্র পর্যন্ত যাবতীয় সাহিত্য সৃষ্টি এতই একপেশে ছিল যে, আমাদের গৌরব করার মত কোনো উপাদানই এতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে জন্যেই বাংলার মুসলিম সমাজ পাকিস্তানের মধ্যে নিজেদের আলাদা অস্তিত্বের সন্ধান করতে চেয়েছিল। সমগ্র ভারতের অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগুরু অঞ্চলে পাকিস্তানের সপক্ষে নির্বাচনী রায় পাওয়া যায়নি অথবা পেলেও সেটা অস্পষ্ট ছিল। পক্ষান্তরে অবিভক্ত বাংলাদেশের ভোট সুস্পষ্টভাবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষেই অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির সপক্ষেই পড়ে। আজ যারা ভারত বিভক্তির জন্য কষে ‘টু নেশন থিওরী'কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে তারাও এ বিভক্তির সরাসরি বেনিফিসিয়ারী। খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবি অন্নদাশঙ্কর রায় সাপ্তাহিক দেশ-এর ১০ নভেম্বর ১৯৯০ সংখ্যায় এরই স্বীকৃতিস্বরূপ লিখেছেন : 'মুসলমানরা পাকিস্তান অর্জন না করিলে একটি সম্প্রদায় হইতে জাতিতে উন্নীত হইতে পারিত না।' এটা ধ্রুব সত্য।

রাষ্ট্রীয় পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই সাংস্কৃতিক পাকিস্তানের পটভূমি রচিত হচ্ছিল। স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম না হলেও স্বতন্ত্রভাবে সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের সংগ্রাম চলছিল। মেজরিটি বাঙ্গালীর মুখের ভাষাকে সাহিত্যাঙ্গন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার ফলে এ ছাড়া আর কোনো গত্যন্তরও ছিল না। যে সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা আমরা নই যে সাহিত্যের পটভূমি আমার কর্মভূমি নয়, যে সাহিত্যের বাণী আমাদের মর্মবাণী নয়, যে সাহিত্যে আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, কিংবদন্তী, উপকথা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত সে সাহিত্য কস্মিনকালেও আমার হতে পারে না। রাধা-কৃষ্ণ, মথুরা-অযোধ্যা যাদের মনকে উদ্দীপিত করে তারা কি আমরা? আজ যদি এটাই বাঙ্গালীর আদি কালচার বলে চালাবার অপচেষ্টা হয় সেটা কি মেজরিটি বাঙ্গালী অর্থাৎ বাঙ্গালী মুসলমান মেনে নেবে? কেউ কেউ হয়তো মেনে নেবে। সেটা হবে ঐতিহাসিক ভ্রষ্টাচার। এরা স্বজাত্যাভিমানী নয়, পরমুখাপেক্ষি, দাস্য মনোভাবসম্পন্ন। বঙ্কিম, রবীন্দ্র, শরৎ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়দের গল্পের নায়ক-নায়িকা, ধ্যান- ধারণা যে সাহিত্যে মেজরিটিকে বর্জন করা হয়েছিল সে সাহিত্য আমাদের জাতীয় সাহিত্য কিভাবে হবে? এসব সুখপাঠ্য সন্দেহ নাই কিন্তু আমরা এদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারলাম কই?

বস্তুত একটি সংবেদনশীল জাতি হিসেবে বাঙ্গালী মুসলমানের অস্তিত্ব এসব কবি-সাহিত্যিকরা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেই এদের রচনাবলীকে সমৃদ্ধ করেছেন। হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্রের রচিত মহাকাব্য থেকে রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম এ ব্যাপারে একই পথের পথিক। সাম্প্রদায়িকতার প্রতিযোগিতায় কমবেশি এই যা।

স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি এটাই। আমরা দুই শরীক আপোসে ভাগ হয়ে গেছি কিন্তু কেউ মচকাইনি। বাংলাকে এর রাখার চেষ্টা করেছিলেন বোস-সোহরাওয়ার্দী ফর্মুলার মাধ্যমে, কিন্তু খোদ গান্ধী-নেহরু এতে রাজি হননি। মুসলিম সংখ্যাগুরু অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুর স্বার্থ রক্ষিত হবে না এ যুক্তিতে। অথচ হিন্দুরা নামমাত্র সংখ্যালঘু হলেও জমিদারী, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বত্র এগিয়েছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও এ আস্থা নেহরু, গান্ধী রাখতে পারেননি। তাহলে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে জিন্নাহ সাহেবকে দোষ দেয়া কেন?
অতএব সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়। বাংলাদেশে বাঙ্গালী, উপজাতীয় ও এদেশে বসবাসকারী সকলেই বাংলাদেশী। কিছু লোক এটাকে আমাদের বাঙ্গালিত্বের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন। পৃথিবীর সর্বত্র একটা দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও নামের সাথে সম্পৃক্ত। শুধু আমাদের বেলায় বাংলা/বাঙ্গালীর সঙ্গে এর কৃত্রিম বিরোধ দেখানো হয়। এর পিছনে কোনো যুক্তিতর্ক নাই, আছে অসৎ উদ্দেশ্যে। জাতিকে স্থায়ীভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত রাখাই এর উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশী জাতীয়তাদের মূলকথা আমরা বাঙ্গালীও বটে বাংলাদেশীও বটে। আমরা বাঙ্গালীও বটে আমরা মুসলমানও বটে, হিন্দুও বটে। আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম নিয়ে আমরা আলাদা জাতির পর্যায়ে পড়ি বলেই আলাদা দেশ করতে পেরেছি। তা না হলে এ রক্তপাত কেন? তা না হলে আমার দেশের স্বার্থকতা কি? আমাদের দেশ ও ধর্ম নিয়ে আমরা একটি জাতি। যে ভাষায় আমরা কথা বলি সে ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা। আমরা যদি অসভ্য বা অশালীন না হই তবে আমাদের ভাষা বা ধর্ম অসভ্য বা অশালীন হবে কেন? আমরা আমাদের দেশকে ভালবাসি কিন্তু ভাষাকে অশালীন মনে করবো কেন? একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকলে সে স্বাধীন জাতির সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষমতা বা যোগ্যতাও আমাদের আছে। আমাদের কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবিদের সে আত্মবিশ্বাস নাই কেন? আমাদের ছাত্র যুবকরা ভাষার জন্য যে রক্ত দিয়েছে তাদের সে মহান আত্মত্যাগ কি অপরের অনুকরণের জন্য ছিল? আমাদের নিজেদের পুনরায় আবিষ্কার করতে হবে। আমাদের সুপ্ত প্রতিভা ও মননকে নতুন রূপ রসে সঞ্জীবিত করতে হবে। যাকে বলা চলে দস্তুর মত রিডিস্কভারী !
পূর্ববাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সামাজিক অনুভূতির নামই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। আবার বলছি এর সঙ্গে আমাদের বাঙ্গালিত্বের কোনো বিরোধ নাই। একটা আমাদের এথনিক পরিচয় অপরটা আমাদের জাতীয় আইডেনটিটি। বাংলা ও বাঙ্গালী নামের হকদার আমরাই। অপর যে অংশটি বৃহত্তর ভারতের সঙ্গে মিশে গিয়ে ভারতীয় জাতীয়তা গ্রহণ করেছে ওদের নেতৃত্বে যাওয়ার মত বুদ্ধির দেউলিয়াত্ব দেখাবার কোনো অবকাশ নেই।
আশ্চর্যের বিষয় যারা এ নন ইস্যুকে একটি ইস্যুর রূপ দিয়েছেন তাঁদের নেতাই এদেশের নামকরণ বাংলাদেশ করেন। বাংলাদেশে আপত্তি নাই কিন্তু বাংলাদেশী হতেই যত আপত্তি? আসলে এ আপত্তি ভেদ বুদ্ধি থেকেই উদ্ভূত। বাংলাদেশ নামের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশীত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এ জলতরঙ্গ রোধের ক্ষমতা কারুর নেই। আজ নয় কাল নয় আগামী শ বছরেও নয়॥"
 
— মহবুব আনাম / আমরা বাংলাদেশী আমরা বাঙ্গালী ॥ [ খোশরোজ কিতাব মহল - এপ্রিল, ১৯৯৭ । পৃ: ৬৫-৭০ ]